- 07 August, 2019
- 0 Comment(s)
- 2990 view(s)
- APDR
আপনার অধিকার রক্ষা করতে কাশ্মীরের মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ান
কাশ্মীরে এবার শান্তি ফিরে আসবে। কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের এই কথাটাই বোঝাতে চাইছে। কীভাবে ফিরবে? বলা হচ্ছে, এই সরকার এমন কয়েকটা পদক্ষেপ নিয়েছে, যা আগেকার কোনও সরকার নিতে সাহসই পায়নি। সত্যিই কি এই পদক্ষেপগুলো শান্তি ফেরাতে পারে? আসুন, সেগুলো কী কী, একবার দেখে নেওয়া যাক।
প্রথম পদক্ষেপটিকে প্রকৃত অর্থেই একটা ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বলা যেতে পারে। একেবারে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটার ম্যাপের ওপর ছুরি চালিয়ে তাকে দুভাগ করে ফেলা হয়েছে। এক ভাগে জম্মু ও কাশ্মীর, আর এক ভাগে লাদাখ। এই দুটোর কোনওটাই কিন্তু আর রাজ্য রইলো না। এখন থেকে তারা হবে ইউনিয়ন টেরিটোরি বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। প্রথমটায় নাম-কা-ওয়াস্তে একটা বিধানসভা থাকলেও, লাদাখে তাও থাকবে না। অর্থাৎ, দু’জায়গারই মানুষরা আর অন্যান্য রাজ্যের মত ভোট দিয়ে নিজেদের রাজ্য সরকার গড়তে পারবেন না। লাদাখের মানুষরা প্রধানত বৌদ্ধ। তাঁরা বহুবার একটি পৃথক রাজ্যের দাবি তুলেছেন। তার বদলে তাঁরা এই পেলেন? কাশ্মীর উপত্যকার জন সংখ্যার বেশিরভাগ, অর্থাৎ মুসলমানদের কথা নাহয় ছেড়েই দিন, জম্মুর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদেরও তো এবার নাকের বদলে নরুন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।এভাবে একটা গোটা রাজ্যের সমস্ত অধিবাসীদের একটা মৌলিক নাগরিক অধিকার এক কলমের খোঁচায় কেড়ে নিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের সম্মান বাড়লো কি?
আরও বলা হল, ভারতের সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ক অনুচ্ছেদ গুলি আর এই দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বলবৎ থাকবে না। প্রথমটি অনুসারে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য এতদিন কিছু বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতো, যেমন, প্রতিরক্ষা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি ও যোগাযোগ বাদে অন্য কোনও বিষয়ে কোনও কেন্দ্রীয় আইন রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া সেখানে লাগু করা যেত না। আর ৩৫ক মোতাবেক এই রাজ্যের ‘স্থায়ী বাসিন্দা’ ছাড়া কেউ সেখানে সম্পত্তি কিনতে পারতো না, এবং ‘স্থায়ী বাসিন্দা’র মাপকাঠি ঠিক করার অধিকার ছিল রাজ্য সরকারের।
এখন, এইসব বিধি তো চালু হয়েছিল স্বাধীনতা ও দেশভাগের সময় কাশ্মীরের রাজা হরি সিং-এর সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তির অঙ্গ হিসেবে, তখনকার হিন্দু রাজার ঘনিষ্ট পণ্ডিতদের দাবি অনুসারে ১৯৩৫ সালে সেই হরি সিং-এরই করা একটি আইনের ওপর ভিত্তি করে। কাশ্মীরের ভারতে যোগ দেওয়ার অন্যতম শর্তই ছিল এটা।
কেউ কেউ বলছেন, অনুচ্ছেদ ৩৭০ ছিল একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা, তা হঠিয়ে দিয়ে এবার একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা করা হল। প্রথমত, বিভিন্ন মামলায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন উচ্চ আদালত বলে দিয়েছে, এটা ভারতীয় সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে, কোনও সরকারই একতরফা ভাবে তাকে বাতিল করতে পারে না (দিল্লি হাইকোর্ট ১১ এপ্রিল ২০১৭: কেস নং ডব্লিউ সি ৯৩০০/২০১৫, সুপ্রিম কোর্ট ১৬ এপ্রিল ২০১৬: সিভিল অ্যাপিল নং ১২২৩৭-১২২৩৮/২০১৬)। তবুও যদি বলেন, এটা চিরস্থায়ী হিসেবে ভাবাই হয়নি, তাহলে বলতেই হয়, কাশ্মীরের ভারতে যোগ দেওয়াটাই তো চিরস্থায়ী নাও হতে পারে, এমন একটা ভাবনা গোড়াতেই ছিল। লিখিত প্রতিশ্রুতি ছিল, কিছুদিন পরে গণভোট করে এবিষয়ে সেখানকার মানুষের মতামত যাচাই করা হবে। এরকম গণভোট অন্য জায়গায় হয়নি যে তা নয়। জুনাগড়ে হয়েছে ১৯৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। আমাদের ঘরের কাছেই সাবেক ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরে হয়েছে ১৯ জুন ১৯৪৯। কাশ্মীরে তা কি হয়েছে কোনওদিন? ভারতের শাসকরা কেউ কথা রাখেনি। তাদের কাছে নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করে এসেছে কেবল। এবারেও তাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে একতরফা ভাবেই এই নয়া “সমাধান” চাপিয়ে দেওয়া হল।
অন্যদিকে, কাশ্মীর থেকে ৩৭০ আর ৩৫ক উঠে গেলেই কি সত্যিই “এক দেশে এক আইন” হয়ে যাবে? বিশেষ মর্যাদা, বিশেষ আইন কি কেবল কাশ্মীরের ক্ষেত্রেই ছিল? সংবিধানের ৩৭১ অনুচ্ছেদ অনুসারে নাগাল্যান্ড, আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম, এমনকি গুজরাট, মহারাষ্ট্র, গোয়া আর অন্ধ্র প্রদেশের মত রাজ্যগুলিও যেসব বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করে, তার কথা তো উঠছে না! কাশ্মীরে নাহয় ৩৫ক ছিল, ঝাড়খণ্ড বা ত্রিপুরার জনজাতি-অধ্যুসিত অঞ্চলে কিংবা সিকিমে গিয়ে জমি কেনার চেষ্টা করলে আইনে আটকাবে না? প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দিই, যে ‘ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট ১৯০৮’ ঝাড়খণ্ডের জনজাতীয় এলাকায় বাইরের লোকেদের জমি কেনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে রাজ্যের বিজেপি সরকার বছর দুয়েক ধরে তা বাতিল করবার চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু স্থানীয় মানুষরা আন্দোলন করে তা ঠেকিয়ে রেখেছেন।
আসলে, ভারতের শাসকরা নিজেদের শাসন কায়েম রাখার জন্যই নানান প্রান্তের মানুষদের নানান “বিশেষ মর্যাদা” বা সুযোগসুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে। আজ হঠাৎ নিজেদের সৈন্যসামন্তের দাপট বাড়িয়ে কোনও জায়গার অধিবাসীদের কাছ থেকে তা কেড়ে নিলে তা শান্তি আনবে কী করে? অধিকার হারিয়ে, মান-মর্যাদা খুইয়ে, মানুষের মনে শান্তি থাকে কি? এতকাল তো কাশ্মীরকে সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের বলে কাশ্মীরীদের দাবিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কাশ্মীরে এখন প্রতি ১০/১২ জন সাধারণ মানুষ পিছু একজন করে সেনা মোতায়েন আছে। তাতে কোনও ফল ফলেছে কী? তাহলে আর এই নতুন পদক্ষেপগুলো কেন দরকার হল?
কেউ আবার বলছেন, জম্মু ও কাশ্মীরে এতকাল সারা ভারতের আইনকানুন লাগু করা যায়নি বলেই নাকি সেখানে উন্নয়ন থমকে ছিল, এবার তার জোয়ার আসবে। তা, বাকি দেশটায়, যেখানে ৩৭০ আর ৩৫ক ছিল না, তার সমস্ত জায়গায় “উন্নয়ন” হয়েছে তো? তাহলে আর এত মানুষ বেকার কেন? পড়াশোনা করেও ছেলেমেয়েরা চাকরি পাচ্ছে না কেন? এত কলকারখানায় তালা পড়ছে কেন? দলে দলে শ্রমিকরা কাজ হারাচ্ছে কেন? হাজার হাজার কৃষককে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হচ্ছে কেন? নাকি, আমরা যাতে এই প্রশ্নগুলো না করতে পারি, তার জন্যেই এত তাড়া ছিল কাশ্মীরের মানুষকে শিখণ্ডী খাড়া করে এই চমক দেখানোর? আসুন, একটু অন্যভাবে ভাবি। আমাদের কেন পেটে টান পড়ছে, মুখে তালা পড়ছে, সেই প্রশ্ন করার অধিকার যদি বজায় রাখতে চাই, তবে জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষের অধিকারের পক্ষেও আমাদের দাঁড়াতে হবে।