- 24 August, 2024
- 0 Comment(s)
- 299 view(s)
- APDR
প্রেস বিবৃতি : ৯ অগস্ট ২০২৪ কলকাতার R G Kar মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে পড়ুয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যা এবং পরবর্তী ঘটনাবলী সম্পর্কে
ASSOCIATION FOR PROTECTION OF DEMOCRATIC RIGHTS(APDR)
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি
১৮ মদন বড়াল লেন
কলকাতা:৭০০০১২
প্রেস বিবৃতি
৯ আগস্ট ২০২৪ কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে স্নাতকোত্তর পাঠরতা এক চিকিৎসককে রাতের ডিউটি চলাকালীন হাসপাতালের মধ্যেই ধর্ষণ এবং খুন করা হয়। পরবর্তী ঘটনাবলি রাজ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নাগরিক সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ার নিরিখে অতীতের প্রায় সব দৃষ্টান্তকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
এর মূল কারণ এই ভয়াবহ ঘটনাটির পরবর্তীতে রাজ্য সরকার এবং আরজিকর মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং সন্দেহজনক নানা পদক্ষেপ এবং আচরণ।
কলকাতা পুলিশ যে সিভিক ভলেন্টিয়ারকে প্রাথমিক অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার করে, পুলিশ কমিশনার সাংবাদিক সম্মেলনে তার সিভিক ভলেন্টিয়ার পরিচয় আশ্চর্যজনকভাবে এড়িয়ে যান। আইন অনুযায়ী ধর্ষিতার নাম-পরিচয় গোপন রাখতেও পুলিশ -প্রশাসন ব্যর্থ হয়।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এবং পুলিশের আচরণে আরও নানান্ অসঙ্গতি দেখা গিয়েছে। সুরতহাল, পোস্টমর্টেম এবং সৎকারের ক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের অস্বাভাবিক দ্রুততা প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা বলে নিগৃহীতার পরিবার, তার সহকর্মীরা এবং নাগরিক সমাজ মনে করেছে। পিতা-মাতার বয়ানে উঠে এসেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সংবেদনহীন এবং ষড়যন্ত্রের আভাস-দেওয়া আচরণ।
রাজনৈতিক দলগুলি এইসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাদের অবস্থান অনুযায়ী প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ করছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে দৃশ্যমান নারীদের এক অভূতপূর্ব অদলীয় প্রতিবাদ। এমনকি জেলা শহর এবং গ্রামগুলিতেও। ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে সারা রাজ্যে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ব্যাপকতা, তেজ এবং দৃপ্ততা, সচেতন নাগরিকদের বিস্মিত ও বিমোহিত করেছে। অধিকার আন্দোলনকে সাহস যুগিয়েছে।
গভীর উদ্বেগের ব্যাপার ওই ১৪ অগাস্ট রাতেই আর জি কর হাসপাতালে প্রতিবাদের অছিলায় একদল দুষ্কৃতীর তান্ডবে হাসপাতালের নানা যন্ত্রপাতি এবং চিকিৎসা সামগ্রী ভাঙচুর , নার্স এবং চিকিৎসকদের ভয় দেখানো এবং প্রতিবাদী চিকিৎসকদের মঞ্চ ভেঙে দেওয় হয়। পুলিশ দাবি করে ওই সময়ই একটি রাজনৈতিক সংগঠনের জমায়েত থেকেই এই হামলা হয়েছে বলে । যদিও সেই দাবির যৌক্তিকতা দুর্বল এবং পরবর্তীতে সংবাদপত্র এবং বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত নানা রিপোর্টে প্রায় পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে এই তাণ্ডব, প্রতিবাদ আন্দোলনকে বদনাম করার জন্য শাসকদলের ষড়যন্ত্রেরই অংশ । হত্যার প্রমাণ বিলোপের জন্য অকুস্থল ভাঙচুর করাও তাদের লক্ষ্য ছিল বলে অনেকেরই অভিমত।
গত ১২ অগস্ট কলকাতা হাইকোর্ট এই হত্যা ও ধর্ষণের মামলার তদন্তের ভার কলকাতা পুলিশের থেকে সিবিআই এর কাছে হস্তান্তর করেছে। এই সমস্ত তদন্তে সিবিআইয়ের অতীত খুব উজ্জ্বল নয়। তবুও যেহেতু রাজ্য সরকার রাজ্যের বিরাট অংশের নাগরিকের কাছে এই ঘটনায় এবং কাজকর্মে আস্থা হারিয়েছে তাই হয়ত আদালতের সিদ্ধান্তে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আজও সিবিআই এই মামলায় কোন নতুন কথা শোনাতে পারেনি। দ্বিতীয় কাউকে গ্রেপ্তারও করতে পারেনি। তাই মানুষ নিদারুণ আশাহত। সর্বশেষ পদক্ষেপ ধৃত অভিযুক্ত সহ বেশ কয়েকজনের পলিগ্রাফ টেস্টে সম্মতি আদায়। পৃথিবী জুড়েই পলিগ্রাফ টেস্ট নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। অভিযোগ, এই টেষ্ট মানবাধিকার বিরোধী। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী কাউকে তার নিজের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যায় না। বস্তুতই এই টেস্টের আয়োজন করার মধ্যে যতটা চমক আছে কার্যকারীতা তার ভগ্নাংশও নয়। পলিগ্রাফ টেষ্ট থেকে পাওয়া 'তথ্য' আইন বা আদালত গ্রাহ্য নয়। রাজ্যের পুলিশ বা কেন্দ্রের পুলিশ কারও উপর ভরসা নয় - এপিডিআর প্রথম থেকেই হাইকোর্টের কর্মরত বিচারপতির নেতৃত্বে এই মামলার বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে এসেছে। এপিডিআর আজও সেই দাবীতেই অনড় আছে।
অধিকার আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা মনে করি এই ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা অত্যন্ত নিন্দনীয়। পুলিশ মন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই বিপর্যয়ের দায় স্বীকার করা উচিত এবং মানুষের স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের চক্রান্ত বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করা উচিত।
সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এবং কূটনীতি-নির্ভর পদক্ষেপ ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের নজির বলে মনে হয়েছে। চিকিৎসকদের চোখে অভিযুক্ত, নিন্দিত এবং এই ভয়াবহ ঘটনায় সন্দেহজনক হাসপাতালের চিকিৎসক-প্রশাসককে আশ্চর্যজনকভাবে রক্ষা করা এবং প্রশংসা করা, কেবল অবিবেচনাই নয় ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং একনায়কত্বের ইঙ্গিতবাহী। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সম্ভাব্য অপরাধীর জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাণ্ডজ্ঞানহীন ফাঁসির দাবি এবং রাজ্যের শাসক দলের এক ক্ষমতাশালী সাংসদের এনকাউন্টারের বিধান। বিচারের আগেই শাস্তি ঠিক করে দেওয়া বা বিনা বিচারে খুন করে দেওয়ার এসব নিদান চরম নিন্দনীয়। প্রতিবাদের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা। মানুষের মনে সন্দেহ, এসব 'হায়দারাবাদী মডেল' কার্যকরী করার চেষ্টা আসলে প্রমাণ বিলোপের ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
এই রাজ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এবং প্রতিবাদের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সাম্প্রতিক জুনিয়র ডাক্তারদের এবং সাধারণভাবে সাধারণ চিকিৎসকসমাজের প্রতিরোধ সেই ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
আমরা মনে করি এই নির্যাতন এবং নৃশংস হত্যা কেবলমাত্র এক বিকৃতমনস্ক পুরুষের সামাজিক ব্যাধির বহিঃপ্রকাশ নয়। এর আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে আমাদের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা এক বিরাট অন্ধকার জগত এবং দুর্নীতির বাস্তবতা।
এই ঘটনার পর সমাজমাধ্যমে নানা অর্ধ-সত্য এবং চরম বার্তায় ভরে উঠেছে। আমরা সকলেই জানি যে ইন্টারনেটবাহী ইলেকট্রনিক সমাজ মাধ্যম নানা চরম মন্তব্য, বার্তা ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হয়। এর মোকাবিলায় প্রয়োজন যথাযোগ্য সুস্থ সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আবহাওয়া তৈরি করা। কিন্তু পূর্ণ বাক-স্বাধীনতার অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন দিয়ে কণ্ঠরোধ করার আমরা তীব্র বিরোধী। আবার ফেসবুক এবং instagram এ সম্ভাব্য অপরাধীদের ছবি প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দেওয়ার কথা বলে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সরকার নাগরিকদের রাস্ট্রের গুপ্তচর বানাতে চাইছে। এটারও আমরা নিন্দা জানাচ্ছি।
ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট স্বত:-প্রণোদিত একটি মামলায় আর জি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একই সঙ্গে এই ঘটনার তদন্ত এবং রাজ্য সরকারের ভূমিকাকে পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে এসেছে। তারই ফলে গত ২০ অগস্ট একটি আদেশে তারা আর জি কর হাসপাতালে কেন্দ্রীয় সুরক্ষা বাহিনী নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে। আমরা মনে করি যে এই নির্দেশ রাজ্যের পক্ষে শুধু অমর্যাদাকর নয়, ভবিষ্যতে সংবিধান বহি:র্ভূতভাবে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ চালু করার অশনি সংকেত। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর অবমাননা। রাজ্য সরকারের ব্যর্থতাই এই পরিণতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী। কেন্দ্রীয় সরকারের সুযোগ সন্ধানী মনোভাব তাকে পুষ্ট করেছে।
এই ঘটনা সারা রাজ্য জুড়ে সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা ও চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যের দিকটিও প্রকাশিত করেছে। একই সঙ্গে সমাজের সমস্ত স্তরে রাজ্যে নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের কিছু পদক্ষেপ চরম অগণতান্ত্রিক। যেমন রাতের কাজ থেকে মহিলাদের নিবৃত্ত করার নিদান। এই ফরমান পশ্চাদগামী এবং রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শ্রমজীবী মহিলাদের দিনরাত নির্বিশেষে কাজের অধিকারের প্রতি চরম অসম্মান। আমরা অবিলম্বে এই সরকারি নিদান প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীদের সমানাধিকারের দাবীকে আবারও জোরের সঙ্গে তুলে ধরছি। নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।রাষ্ট্রকে সে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি :
•R G Kar হাসপাতালে কর্মরত মহিলা ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের বিচার চাই।
*হাইকোর্টের কর্মরত কোন বিচারপতির নেতৃত্বে বিচারবিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।
• ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা আড়াল করার অভিযোগে কলকাতার পুলিশ কমিশনার, হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও অন্যান্য কর্মকর্তাকে তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
• রাজ্যে পূর্ণ সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ করতে হবে।
* সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিকাঠামো উন্নত করে সকল স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
• প্রশাসক এবং ক্ষমতাবান জনপ্রতিনিধিদের ফাঁসি এবং এনকাউন্টারের মতো দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন এবং হিংস্র দাবি থেকে বিরত থাকতে হবে।
সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষে,
রঞ্জিত শূর,
সাধারণ সম্পাদক,
এপিডিআর।
২৪/০৮/২৪