- 27 June, 2020
- 0 Comment(s)
- 3909 view(s)
- APDR
অধিকার জুন-জুলাই-আগস্ট - ২০২০
লকডাউনের বাজারে কোলাহল তো এমনিতেই বারণ। জমায়েত চলবে না, মিটিং-মিছিল চলবে না, কারণ ‘সামাজিক দূরত্ব’ বজায় রাখতে হবে। কিন্তু তাতেও রক্ষে নেই। কেউ একা একা নিজের মত প্রকাশ করলেও মুশকিল হতে পারে, যদি সেই মত শাসকদের বিরুদ্ধে যায়। তার ওপর আরেকটা দিকেও এখন সদা সতর্ক থাকতে হচ্ছে, তা হল, শুধু সরকার নয়, আদালত না আবার কোনও কথায় অপমানিত বোধ করে বসে।
আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করেছে সুপ্রিম কোর্ট, এবং তাঁকে দোষী সাব্যস্তও করেছে। এই মামলার উপলক্ষ ছিল প্রশান্তের দুটি টুইট। কারও অভিযোগের ভিত্তিতে নয়, কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই মামলা দায়ের করেছে এবং স্বয়ং প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ তার বিচার করেছে। প্রশান্ত ভূষণ দীর্ঘকাল ধরে ওই আদালতে প্র্যাকটিস করছেন। জনগণের অধিকারের প্রশ্ন যেখানেই জড়িত, সেখানেই তাঁকে দেখা গেছে পারিশ্রমিকের কথা না ভেবে নির্দ্বিধায় আইনি লড়াইয়ের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে। এপিডিআর-এর হয়ে সিঙ্গুরের জমিহারা কৃষকদের জমি ফেরানোর মামলায় তাঁর পরিচালনায় যে সাফল্য এসেছে, সেকথা সবাই জানেন। এখন যশোর রোডের হাজার হাজার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন গাছ বাঁচানোর লড়াইও সুপ্রিম কোর্টে, এবং তা তিনিই লড়ছেন।
জনগণের অধিকারের বন্ধু এহেন একজন আইনজীবীর ওপর শাসনের খাঁড়া নেমে এলে তা জনগণের এবং আমাদের মত অধিকার সংগঠনগুলির ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বই কি। তাই এই মামলার রায় ঘোষণার আগেই সারা দেশ থেকে সুপ্রিম কোর্টের কাছে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য অনেক আবেদন গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে আবেদনটি যায়, তাতে সই করেছিলেন বহু বরিষ্ঠ আইনজ্ঞ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব এবং অধিকার কর্মীরা। বোঝাই গেল, এসব আবেদন বিচারপতিদের গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। তাঁরা তাঁদের রায়ে বললেন, “এই ধরনের আক্রমণ যদি যথাযথ দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করা না হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের মান এবং মর্যাদার ক্ষতি করতে পারে। নির্ভিক ও নিরপেক্ষ বিচারালয়গুলি হল স্বাস্থ্যবান গণতন্ত্রের নিরাপত্তাবলয়, এবং তার ওপর কোনও বিদ্বেষপরায়ণ আক্রমণের মাধ্যমে তার প্রতি আস্থা টলিয়ে দেওয়া অনুমোদন করা যায় না।” (অনুবাদের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিবিচ্যুতি মার্জনীয়।)
এখানেই কিছু প্রশ্ন উঠে যায়। একটা মন্তব্য কি এতই জোরদার হওয়া সম্ভব, যে তা একেবারে জগৎসভায় দেশের আসন টলিয়ে দিতে পারে? আর আদালতগুলি যদি নির্ভিক ও নিরপেক্ষই হয়, তাহলে তো তাদের ওপর জনগণের আস্থা অবিচল থাকতে বাধ্য, যে যাই বলুক না কেন।
রায় বেরোনোর পর সারা দেশ থেকে বহু প্রাক্তন বিচারক সহ আইনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত তিন হাজারেরও বেশি মানুষ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “গণতন্ত্রে প্রতিটি সংস্থাকেই জনগণের কাছ থেকে ভালবাসা ও সম্মান অর্জন করে নিতে হয়, এবং প্রত্যেক শক্তসমর্থ সংস্থার বৈশিষ্ট্য হল জনগণের নজরদারি আর মন্তব্যের জন্য নিজেকে উন্মুক্ত রাখা। কেউ যদি বিচারবিভাগের কাজকর্ম সম্পর্কে সমালোচনামূলক মতামত ব্যক্ত করতে চান, এই রায় তাঁদের ওপর এক হিমশীতল প্রভাব ফেলবে। অংশীদারদের সমালোচনাকে রুদ্ধ করে দেওয়াটা কোনও সংস্থার পক্ষেই ভাল নয়, বিশেষ করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের পক্ষে তো নয়ই।”
ইংল্যান্ডে ১৯৮৭ সালে বিখ্যাত ‘স্পাইক্যাচার’ মামলায় তখনকার আপিল মামলার সর্বোচ্চ বিচারপতি ‘ল লর্ড’-দের এক রায়ের প্রতিবাদে তিনজন ল লর্ড-এর ছবি উলটো করে ছেপেছিল ট্যাবলয়েড কাগজ ‘ডেইলি মিরার’। তলায় লিখেছিল, “ইউ ওল্ড ফুলস” (তোমরা বোকা বুড়ো)। তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে ব্যবস্থা নিতে অস্বীকার করে লর্ড টেম্পলটন বলেছিলেন, “আমি এটা অস্বীকার করতে পারি না যে আমি বুড়ো; এটা সত্যি। আমি বোকা কিনা তা অন্যদের ধারণার বিষয়... এখানে আদালত অবমাননা সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করবার কোনও দরকার নেই।”
আমাদের দেশের অন্যতম অধিকারবান্ধব বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আইয়ার বলেছিলেন, “বিচারকদের নিজেদের মধ্যেই যদি পচন ধরে, আদালত অবমাননা সংক্রান্ত ক্ষমতা তাদের বাঁচাতে পারবে না।”
এসব কথা আমরা আর কি মনে করিয়ে দেবো, মহামান্যরা সবই তো জানেন। কেবল এইটুকু বলতে পারি যে জনগণ শাস্তির ভয়ে কোনও সংস্থাকেই সমালোচনার অধিকার ছাড়বে না। নাহলে গণতন্ত্র থাকবে না। জগৎসভায় এভাবে আমাদের মানসম্মান হারাতে আমরা চাই না।
সংখ্যাটি ডাউনলোড করুন এখান থেকে