- 10 December, 2019
- 0 Comment(s)
- 3525 view(s)
- APDR
আসুন মানবাধিকারের দাবীতে উঠে দাঁড়াই
বহু মানুষের উদ্যোগে ও আত্মত্যাগে মানবাধিকার আন্দোলন আজ সব মানুষের বড় ভরসাস্থল ও অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ব্যর্থ-শাসকের চোখ রাঙানীর মুখে দাঁড়িয়ে মানবাধিকার। আজকের ১০ই ডিসেম্বর তাই আগামী দিনের বড় বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আসুন দেখে নিই চ্যালেঞ্জগুলিকেঃ- বিশ্বজুড়ে (কর্পোরেট) স্বৈরাচারের দাপটে সমস্ত দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি, ব্যক্তি মর্যাদা ও অধিকার বিপন্ন। এদেশেও রাষ্ট্রের সন্ত্রাস মানুষের মাথা নুইয়ে দিচ্ছে। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা মানে মৃত্যুবরণ! বুটের তলায় মানবাধিকার। আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলির মতো এদেশের প্রতিষ্ঠানগুলিও সরকারের ত্রাসে বিপর্যস্ত; তারা মানুষকে সামান্য সুরাহা দিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বিরোধী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ, এ দেশেও। অধিকারকর্মী, কৃতী মানুষ যারা সমাজের বিবেক হিসাবে সাধারণ ও পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই করেন, তারাই মিথ্যা ও সাজানো মামলায় বছরের পর বছর জেলবন্দী। দেশজোড়া এক সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরী করে সরকার নিজের চরম ব্যার্থতা ঢাকতে চাইছে। শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা করা ছাড়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ১৫ লক্ষ টাকা বা বছরে ২ কোটী চাকরী কিছুই পালন করেনি। বেকারত্ব সর্বোচ্চ মাত্রা ছুঁয়েছে। আর্থিক দশা তলানীতে। “মানবাধিকারের পাশ্চাত্যের মানদন্ড ভারতে অন্ধভাবে প্রয়োগ করা যাবে না” - স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথা বলার পর প্রশ্ন জাগে মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ভারত তার কতটুকু পালন করবে? অগণতান্ত্রিক ভাবে ৩৭০ ও ৩৫এ রাতারাতি বাতিল করে সারা কাশ্মীরের মানষুকে বন্দী রাখা হয়েছে। সেখনে নিখোঁজ মানুষের খোঁজে ৬০০ হেবিয়াস কর্পাস মামলা হয়েছে শ্রীনগর হাইকোর্টে। প্রায় ১৩০০০ মানুষ বেআইনী ভাবে আটক। পেলেট গানে শতাধিক মানুষ দৃষ্টি হারিয়েছে, আট মাসের শিশুও রাষ্ট্রের হিংসার শিকার। স্কুল-কলেজ, দোকানপাট বন্ধ। এসবের পরেও একমাত্র সরকারী ভাষ্য “কাশ্মীর স্বাভাবিক”! আগষ্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে কাশ্মীরে ১২৫ টি প্রকল্পকে বনভূমি ধ্বংস করার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বিজেপি ঘনিষ্ট শিল্পপতিরা লোলুপ দৃষ্টিতে ভূস্বর্গের জমির দিকে তাকিয়ে। বাবরি মসজিদ ১৯৯২-এ হিন্দু উগ্রবাদীরা ধ্বংস করে। ২০১৯-এ সুপ্রীমকোর্ট এই কাজ অন্যায় বলে মেনে নিয়েও হিন্দুদের পক্ষে রায় দান করায় প্রশ্ন উঠেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা নিয়ে; সেখানেও কি ভয় বাসা বাঁধছে! শ্রম আইনের খোল-নোলচে বদলে শ্রমের অধিকার ও শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা, ইউনিয়ন করার অধিকার, চাকরীর স্থায়িত্ব সবকিছুই কর্পোরেট লগ্নিপুঁজির হাতে সঁপে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। তথ্য জানার অধিকারও এখন কেন্দ্রীয় সরকার কুক্ষিগত করেছে RTI আইন বদল করে। বনাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ একর কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়েছে - ঐসব অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের মিথ্যা মামলা, হত্যা, লুঠ, ধর্ষণ ও উচ্ছেদ ক’রে। এছাড়াও বড় বাঁধ, জল বিদ্যুৎ প্রকল্প, শহরাঞ্চলে বস্তি নির্মূল, রাস্তা চওড়া করা, স্মার্ট সিটি, সৌন্দর্যায়নের নাম করে চলছে ব্যাপক উচ্ছেদ। পুনর্বাসন দূর অস্ত; কারণ, এদের পক্ষে আদালতে গিয়ে ন্যায় বিচার পাওয়া সাধ্যের বাইরে। গ্রামসভাগুলির অধিকারও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। UAPA আইনের দৌলতে সবাই অজান্তেই সন্দেহভাজন সন্ত্রাসবাদী। বনভূমির সংজ্ঞা পাল্টে দিয়ে সরকার বনভূমি বিস্তারের গল্প শোনাচ্ছেন। বৃক্ষ-নিধন সরকারের ঘোষিত ‘উন্নয়ন নীতি’ এখন। দূষণের বিরোধিতা করে তুতিকোরিনের মানুষ পেয়েছিল বুলেট - যাতে ১২ জনের প্রাণ যায়। দেশের রাজধানীতে দূষণের জন্য স্কুল বন্ধ রাখতে হচ্ছে ও বাসিন্দারা মৃত্যু ভয়ে শহর ছেড়ে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচী, স্বাধিকার, পড়ার খরচ, গবেষণার বরাদ্দ, ছাত্রদের স্কলারশীপ সবই আক্রান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের হিন্দুত্ববাদী সংকীর্ণতায়। ভারত শিশু মৃত্যুর রেকর্ড গড়েছে, ক্ষুধা তালিকায় ভারত ১১৭ টি দশের মধ্যে এবছরে ১০২ নম্বরে। সরকারি স্বাস্হ্য-ব্যবস্থা অপ্রতুল (দেশে ১লক্ষ লোকের জন্য ডাক্তার সংখ্যা মাত্র ৬৫ জন)। স্বাস্থ্য-বীমা, ওষুধপত্র, চিকিৎসা ব্যবস্হা বহুজাতিক কোম্পানীর গ্রাসে।
নারী নির্যাতনে ভারত বিশ্বে প্রথম সারিতে স্হান করে নিয়েছে। ভারতে প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হয়। নর্ভয়া কান্ডের পরেও কাঠুয়া, উন্নাও, হায়দ্রাবাদে নারী ধর্ষণ-খুনের ধারাবাহিকতা বিদ্যমান। বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরাও অভিযুক্ত। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কাশ্মীর, মধ্যভারত, উত্তর-পূর্ব ভারতে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ ক্রমবর্ধমান। নারীর সম্মান ভূলুন্ঠিত। বিচারব্যবস্হার প্রতি মানুষ ভরসা হারাচ্ছে – ফলে গণপিটুনী, ফেক এনকাউন্টার জনমানসে বৈধতা পাচ্ছে। হায়দ্রাবাদে চারজন অভিযুক্তকে হেফাজতে হত্যা করে পুলিশ যে নিন্দনীয় কাজ করেছে তা এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে মানবজাতিকে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমান রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্ত করার; পরিবর্তে নিজের ঢং-এ রাজনৈতিক বন্দীদের সংজ্ঞাটাই তারা মুছে দিয়েছে। হেফাজতে এর মধ্যে এপ্রিল-২০১৭ থেকে ফেব্রুয়ারী-২০১৮ পর্যন্ত ১১ মাসে ১২৭ জন বন্দীর মৃত্যু পশ্চিমবঙ্গকে উত্তরপ্রদেশের পরেই স্হান করে দিয়েছে। হেফাজতে মৃত্যু সংবিধানের ২১নং ধারার অবমাননা। State Sentence Review Board-এর সুপারিশ উপেক্ষা করে রাজ্য সরকার ১৪ বছরের বেশী জেল বন্দী প্রায় ১০০ মানুষকে এখনও আটক রেখেছে। জেলের ৯৯২ টি শূন্যপদ সরকার পূরণ করছে না। আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার বেচে দিচ্ছে, আলিপুর মহিলা সংশোধনাগার, প্রেসিডেন্সী জেলও বে-সরকারি আবাসন প্রকল্পের আওতায়। এটাই তার মানবাধিকার চর্চার ধরণ। পুলিশের গুলি চালনার একটিরও তদন্ত করেনি সরকার। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও আন্দোলনেও পুলিশ ও রাজনৈতিক হামলা ঘটাচ্ছে। এ রাজ্যের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও সংস্কৃতির অবশিষ্টটুকু নষ্ট ক’রে দলতন্ত্র কায়েম করতে এবং গণতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে ‘উন্নয়ন’-এর কথা শোনাতে চায় সরকার ও শাসকদল। বাংলার সমাজকে স্বার্থান্বেষীদর হাতে তুলে দিচ্ছে তারা। উগ্র হিন্দুত্বের বদলে নরম হিন্দুত্বের চাষ করতে চাইছে রাজ্য সরকার। এই সরকারের ‘নীতি’ নেই, আছে ‘পপুলিজম’-এর কছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের আইনসভা এখন হিন্দুরাষ্ট্রের প্রবক্তাদের হাতে। সংবাদপত্র, টিভি-চ্যানেলগুলো মূলত সরকারি ভাষ্যের প্রবক্তা। হাতে গোনা যে কয়েকটি মিডিয়া স্বাধীন সংবাদ পরিবেশন করছে তারা কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের কুনজরে। শেখ শোহরাবুদ্দীন মামলার বিচারপতি লোয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে, সেই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্’র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় নীতির বিরোধিতা ক’রে শাহ্ ফয়জল বা কান্নান গোপীনাথন বা শশীকান্ত সেন্হিল মানবাধিকর সচেতন IAS আধিকারিকরা পদত্যাগ করেছেন, যা ভবিষ্যেতর ইঙ্গিত কারণ, গণতন্ত্রের চার স্তম্ভই আজকের ভারতে বিপন্ন। ‘এনআরসি’ মানুষের বিরুদ্ধে এক জঘন্য ও অমানবিক কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। তার প্রথম ধাপ ‘এনপিআর’ ১লা এপ্রিল, ২০২০ থেকে রাজ্যে শুরু হতে চলেছে। ঘৃণার রাজনীতি ছড়িয়ে হিন্দুরাষ্ট্রের পথকে মসৃণ করা, দাসপ্রথা ফিরিয়ে আনা, কর্পোরেটের স্বার্থে ভারতবর্ষকে সস্তা শ্রমের আড়তে পরিণত করাই এর উদ্দেশ্য। ‘ক্যাব’ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষে এমনই একটা সংবিধান বিরোধী বিল। এই ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার ডাকই মানবাধিকার দিবসের প্রধান ডাক; সমবেত হোন, ‘এনআরসি’ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করুন। মানবাধিকারকে জয়যুক্ত করুন। এবারের মানবাধিকার দিবসের দাবী হোক - মানুষে মানুষে বিভাজন নয়, জাতের লড়াই নয়, হিংসা-ঘৃণা-বিদ্বেষ নয়; মানুষের মর্যাদা ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করেই খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্হান, শিক্ষা, স্বাস্হ্য সংস্কৃতির অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
১০/১২/১৯
গণতান্ত্রিক অধিকর রক্ষা সমিতির পক্ষে, ১৮, মদনবড়াল লেন, কলকাতা–১২ সম্পাদক ধীরাজ সেনগুপ্ত কর্তৃক প্রচারিত
লিফলেটটি ডাউনলোড করুন এখান থেকে