- 24 March, 2021
- 0 Comment(s)
- 1469 view(s)
- APDR
প.বঙ্গে আটক সমস্ত রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে এপিডিআর-এর স্মারকপত্র
প্রতি
শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্মানীয় মুখ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
নবান্ন, হাওড়া
মাননীয়া,
আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে এরাজ্যের জেলগুলিতে শতাধিক রাজনৈতিক ও গণ আন্দোলনের কর্মী বহু বছর ধরে বন্দি হয়ে আছেন। অধিকাংশই বিচারাধীন বন্দি এবং ১০-১১ বছর ধরে 'বিচারাধীন'। এর অর্থ, রাজনৈতিক কারণে তাদেরকে ন্যায়-বিচার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সাজাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বন্দিরাও প্রায় দু'দশক ধরে সাজা খাটছেন। এদের অনেকেই বয়স্ক ও অসুস্থ। এছাড়াও বেশ কয়েক হাজার রাজনৈতিক ও গণ আন্দোলনের কর্মী আছেন যারা জামিনে মুক্ত হলেও বিভিন্ন জেলায় ছড়ানো মামলায় মামলায় জেরবার হয়ে যাচ্ছেন। প্রায় এক দশক ধরে তাদের মামলাগুলি চলছে, তো চলছেই। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে এই সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীরা কেউই ব্যক্তিগত কোন লাভের জন্য আন্দোলনে সামিল হয়ে কারাবন্দি হননি। রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা পালন করতে গিয়েই তাঁরা জেলবন্দি।পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক এবং গণতান্ত্রিক পরম্পরায় রাজনৈতিক মতাদর্শগত কারণে কেউ আইন ভেঙে জেলে গেলে তাঁকে সাধারণ অপরাধীর সঙ্গে একই ভাবে দেখা হয় না। এটাও আপনার জানা যে এই বাংলার জেলে আটক রাজনৈতিক বন্দিদের বড় অংশই আর্থিক ও সামাজিক ভাবে সমাজের সব থেকে দুর্বল ও বঞ্চিত অংশ থেকে আসা। অধিকাংশই পশ্চিমবাংলার জঙ্গলমহলের বাসিন্দা। দীর্ঘ বন্দিজীবন এদের অনেকেরই গোটা যৌবন কেড়ে নিয়েছে। অনেকেরই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন তছনছ হয়ে গেছে। দ্রুত বিচার বা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত এইসব মানুষের হারিয়ে যাওয়া যৌবন বা স্বপ্নগুলি আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না সরকার এবং আদালত। সমাজও তাদের কাছ থেকে যে সেবা পেতে পারত তা থেকে বঞ্চিত হল। রাজনৈতিক বন্দীদের তথ্য পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় যেসব বন্দি উচ্চ বা উচ্চতর আদালতে যেতে পেরেছেন বা ভালো আইনজীবীর সহায়তা পেয়েছেন তারা অনেকেই বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অর্থাৎ সাজানো মামলায় তাদের বন্দি রাখা হয়েছিল। কিন্তু উচ্চ আদালতে যাওয়ার জন্য যে আর্থিক সংগতি দরকার অধিকাংশ বন্দীর পরিবার-পরিজনের সেই সঙ্গতি নেই। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তির প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও গণতন্ত্রর প্রতি আস্থা থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বলতে চাই, আপনার গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক সদিচ্ছা কার্যকর হওয়া আগেই প্রয়জন ছিল। কিন্তু, এই মুহূর্তে তা কার্যকর করার প্রয়োজন আরও বেড়েছে। কারণ, এক ভয়ংকর মৌলবাদী শক্তি দেশের সংবিধান স্বীকৃত মতপ্রকাশ ও প্রতিবাদের অধিকার এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিতে উদ্যত। এনআইএ, ইউএপিএ, এন এস এ, রাষ্ট্রদ্রোহীতার মত আইনগুলিকে যথেচ্ছভাবে প্রয়োগ করে সারা দেশে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে। এই অবস্থায় রাজ্য সরকারের জোরের সঙ্গে নিজস্ব ভিন্ন অবস্থান ব্যক্ত করে সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা টানা দরকার। দেশের আইনেই মামলা প্রত্যাহার করে বিচারাধীন বন্দীরের এবং সাজা কমিয়ে বা ক্ষমা ঘোষণা করে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার অধিকার রাজ্য সরকারের আছে। দেরিতে হলেও নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তকে আমরা দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানাই। একইভাবে দার্জিলিংয়ের গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারকেও আমরা স্বাগত জানাই। আমরা প্রত্যাশা করি একইরকমভাবে লালগড়-নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় বামফ্রন্ট সরকারের বা পরবর্তীকালে চাপানো সব মামলাই আপনি প্রত্যাহার করে নেবেন। প্রত্যাহার করে নেবেন রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে আনা অন্যান্য সমস্ত মামলাও। সাজাপ্রাপ্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে তাদের মুক্তি দেবেন। কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ সহ বহু রাজ্যেই মামলা প্রত্যাহার করে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার ভুরি ভুরি উদাহরন আছে। এমনকি বহু খুনের মামলাও অনেক রাজ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে ও হচ্ছে। এরাজ্যেও অতীতে বহু রাজনৈতিক খুনের মামলা প্রত্যাহৃত হয়েছে। এমনকি ফাঁসির আদেশ হয়ে যাওয়ার পরেও অভিযুক্তকে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি মাওবাদী সন্দেহে ধৃত বন্দি সহ সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে তাদের প্রতি যে নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ হয়ে চলেছে তা শেষ করার পক্ষে আপনার কাছে আরও অজস্র যুক্তি আছে। অবিলম্বে তাঁদের নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে এবং সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করে আপনার সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন - আপনার কাছে এটাই এপিডিআর-এর প্রত্যাশা রইলো।
আমরা আরও চাই যে এ রাজ্যের ফৌজদারী বিচারের অন্যান্য নানা দিকের মানবাধিকার-সম্মত সংস্কারের প্রতি আপনার সরকার উদ্যোগী হবে যার কয়েকটি গুররুত্বপূর্ণ দাবি এই স্মারকপত্রের সঙ্গে আপনার নজরে আনা হল।
আন্তরিকতার সঙ্গে-
ধীরাজ সেনগুপ্ত,
সাধারণ সম্পাদক,
এপিডিআর।